ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের আত্মবিশ্বাসের সংকট: দেশের সেরা শিক্ষার্থীরাও হতাশ কেন?
দুর্জয় দাশ তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ [ইউএসটিসি]
ল্যাব রিপোর্ট, এসাইনমেন্ট, মুখস্থবিদ্যার চাপে হাঁপিয়ে উঠছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রকৌশলীরা। গুগল, টেসলা কিংবা স্পেসএক্স-এর স্বপ্ন নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু করা শিক্ষার্থী যখন নিজের স্কিল নিয়েই সন্দেহে পড়ে যায়, তখন বোঝা যায়—ব্যবস্থায় কোথাও একটা বড় সমস্যা আছে।
১. চাকরির বাজার: প্রকৌশলীর কাজ নেই, ডিগ্রিধারীর ভিড় আছে
প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৩০,০০০–৩৫,০০০ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট হয় (সূত্র: University Grants Commission)। কিন্তু চাকরির বাজার সে তুলনায় প্রস্তুত নয়। সরকারি নিয়োগে বছরে কয়েকশ’র বেশি প্রকৌশলী নিয়োগ হয় না (BPSC রিপোর্ট অনুসারে)।
প্রাইভেট সেক্টরে আবার প্রকৌশলীর চেয়ে ম্যানেজার বা রিপোর্টিং স্কিলধারী জনবলকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রকৌশলীরা প্রজেক্টের মাঠে নয়, বরং Excel Sheet-এর পেছনে সময় কাটান!
২. পাঠ্যসূচি বনাম বাস্তবতা: বইয়ের বাইরেই আসল শিক্ষা
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কারিকুলাম এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওরি নির্ভর ও মুখস্থভিত্তিক। ল্যাবের যন্ত্রপাতি বা সফটওয়্যার সীমিত হওয়ায়, শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
আজকের বিশ্ব প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের যুগ, যেখানে প্র্যাকটিক্যাল স্কিল ছাড়া প্রকৌশলী হয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। অথচ আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাস্তব সমস্যা সমাধানের আগেই গ্র্যাজুয়েট হয়ে যায়।
৩. CGPA বনাম স্কিল: বিভ্রান্তির দোলাচলে শিক্ষার্থী
অনেকে শুধুমাত্র CGPA বাড়ানোর দৌড়ে স্কিল ডেভেলপমেন্টকে ভুলে যান। অথচ ইন্ডাস্ট্রি এখন এমন প্রকৌশলী চায়, যারা সমস্যা দেখেই সমাধান করতে পারেন।
BDJobs ও The Business Standard-এর মতে, এখনকার নিয়োগকারীরা CGPA-এর পাশাপাশি প্রজেক্ট, ইন্টার্নশিপ ও প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্সে বেশি গুরুত্ব দেন। CGPA অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেটাই একমাত্র মানদণ্ড নয়—এই বার্তাটি ছাত্র, শিক্ষক ও নিয়োগদাতা—তিন পক্ষেরই বোঝা প্রয়োজন।
৪. কমিউনিটি সংকট: একা শেখা নয়, একসাথে শেখার সময়
উন্নত দেশে ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য ক্লাব, স্টার্টআপ, ওপেন সোর্স প্রজেক্টে অংশগ্রহণের বড় সুযোগ থাকে। সেখানে শেখা হয় দলগতভাবে ও সহযোগিতার মাধ্যমে।
বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় এতটাই ব্যস্ত যে সহযোগিতা নয়, বরং ‘আমি জানি, তুই জানিস না’ সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। ফলে শেখার সুযোগও কমে যায়, বন্ধ হয় জ্ঞানের আদান-প্রদান।
৫. অর্থ না প্রকৌশলী?—কোনটা আগে?
যদি কেউ শুধুমাত্র উচ্চ বেতন বা সামাজিক মর্যাদার আশায় প্রকৌশল বেছে নেয়, সে হয়তো পেশার আসল দায়বদ্ধতা বুঝতে পারবে না। প্রকৌশল হল উদ্ভাবন, সমস্যা সমাধান, এবং মানুষের জীবনকে উন্নত করার দায়িত্ব।
শুধু চাকরির জন্য নয়, দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার ভাবনা নিয়েই প্রকৌশলী হওয়া উচিত।
৬. দেশের বড় কাজে বিদেশি প্রকৌশলী: তাহলে নিজেদের অবস্থান কোথায়?
পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প—সবখানেই বিদেশি প্রকৌশলীর সহায়তা নিতে হয়েছে।
প্রশ্ন জাগে—তাহলে BUET, CUET, RUET, KUET-এর মেধাবী প্রকৌশলীরা কোথায়?
BANBEIS-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইনোভেশনের জন্য ফান্ড, গবেষণা ল্যাব, বা বড় দায়িত্ব পাওয়ার সুযোগ এতই সীমিত যে অনেকেই বিদেশমুখী হন।
৭. সেরা শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাচ্ছে: কারণ কী?
উত্তর সহজ—সুযোগ।
বিদেশে তারা পায় উন্নত গবেষণার পরিবেশ, ভালো বেতন, এবং আন্তর্জাতিক সম্মান। The Daily Star-এর একটি রিপোর্ট বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০-এর বেশি মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছাড়েন, যাদের অনেকেই আর ফেরেন না। ফলে দেশের বিনিয়োগ, দেশের কাজে না এসে অন্য দেশের উন্নয়নে যুক্ত হয়।
৮. মানসিক চাপ ও হতাশা: অদৃশ্য শত্রু
প্রকৌশল পড়ুয়াদের জীবনে অধিকাংশ সময়েই চাপ থাকে—প্রজেক্ট, প্রেজেন্টেশন, পরীক্ষা, পরিবার, ক্যারিয়ার পরিকল্পনা—সব একসাথে সামলাতে হয়।
কিন্তু অধিকাংশ ক্যাম্পাসে কাউন্সেলিং সেবা বা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো সচেতনতা নেই। ফলে হতাশা ও আত্মবিশ্বাসের সংকট জন্ম নেয়, যা ধীরে ধীরে ছাত্রকে নিঃশেষ করে দেয়।
৯. নারী প্রকৌশলীদের জন্য বিশেষ সহায়তা দরকার
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও, অনেকেই মধ্যপথে ক্যারিয়ার থেকে সরে যান।
এর পেছনে কাজ করে—পারিবারিক বাধা, নিরাপত্তার অভাব, আর কর্মস্থলের অনুপযুক্ত পরিবেশ। টেকসই নারী নেতৃত্ব গড়তে হলে পলিসি ও পরিবেশ—দুটোই উন্নত করতে হবে।
**সমাধান?
সমাধান দিয়ে আর কি হবে?
সমাধান আমরা নিজেই।**
মেধা যেন দেশের জন্যই কাজ করে।
আসুন, আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়ি যেখানে একজন প্রকৌশলী কেবল চাকরির জন্য নয়—গর্ব ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে পারেন।
প্রকৌশলী মানেই শুধু চাকরি নয়—উদ্ভাবন, উন্নয়ন আর আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। এই চেতনায় এগিয়ে যাক বাংলাদেশের প্রকৌশল সমাজ।
Leave a Reply