চট্টগ্রামে তবলা তৈরিতে যাঁর নাম এক ঐতিহ্য: রমেশ চন্দ্র দাশ।
যীশু সেন :-
বাংলা সংগীতের ঐতিহ্যবাহী ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র “তবলা”। দুইটি মূল অংশ, ডাঁয়া (ডান হাতে বাজানোর অংশ) এবং বাঁয়া (বাম হাতে বাজানোর অংশ) নিয়ে গঠিত এই বাদ্যযন্ত্রটি শুধু ছন্দের মাধ্যম নয়, বরং ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় ও লোকসংগীতের প্রাণ। কাঠ, ধাতু, চামড়া, মাটি এবং অন্যান্য উপাদানে তৈরি এই যন্ত্রটি নিখুঁতভাবে প্রস্তুত করতে যেমন প্রয়োজন সুক্ষ্ম কারিগরি দক্ষতা, তেমনি প্রয়োজন একান্ত সাধনা ও পরিশ্রম।এই সাধনার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি হচ্ছেন তবলা প্রস্তুতকারক রমেশ চন্দ্র দাশ – যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই শিল্পে তাঁর কুশলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তিনি চামড়ার ছাউনী যুক্ত, মৃদঙ্গ, তবলা, পাকোয়াজ, ঢাক-ঢোল, কঙ্গ-বঙ্গ, জোরখাই ইত্যাদি বিক্রি ও যত্ন সহকারে মেরামত করে সুদীর্ঘ বছর।
রমেশ চন্দ্র দাশের জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার ৩নং ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামে। পিতা ছিলেন ক্ষুদিরাম দাশ এবং মাতা শ্যাম দাশ। পিতার পেশা ছিল কবিগান – এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই ছিল রমেশ দাশের প্রেরণার প্রথম উৎস। সংগীত ও ছন্দে বড় হয়ে ওঠা এই শিল্পী শৈশব থেকেই তবলার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি অনুভব করেন, তবলা শুধু শব্দ নয়, একেকটি তাল যেন জীবনের গল্প বলে।
তবলা নির্মাণের এই সৃজনশীল যাত্রা শুরু হয় ফটিকছড়ির বিশিষ্ট তবলা গুরু মন্টু দাশের অধীনে। ‘তাল তরঙ্গ’ নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মন্টু দাশের থেকে রমেশ দাশ তবলা প্রস্তুতের সূক্ষ্ম কৌশলগুলো হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করেন। এর পাশাপাশি, সংগীতযন্ত্রের গঠন, কাঠের মান, চামড়ার ধরন এবং স্কেলের উপযোগিতা সম্পর্কে দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সুদীর্ঘ ১০ বছরের চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা শেষে তিনি নিজেই তৈরি করেন নিজের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান।
১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের লাভলেইন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নিউ তাল তরঙ্গ’। এটি কেবল একটি তবলা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সংগীতপ্রেমীদের জন্য এক নির্ভরশীলতার প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে সংগীতজগতে বহু গুণী তবলা প্রস্তুতকারক, শিক্ষানবিশ এবং সঙ্গীত অনুরাগী শিক্ষা লাভ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন।
এই প্রতিষ্ঠানে তৈরি তবলাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো নিম কাঠের ডাঁয়া, মাটি, পিতল বা সিলভারের বাঁয়া এবং স্কেলের দিক থেকে এ, সি, ডি, এফ সার্প স্কেলের– বিভিন্ন ঘরানার তবলা। দক্ষ হাতে তৈরি প্রতিটি তবলা যেন এক একটি ছন্দের প্রতিমা। চামড়া হিসেবে ব্যবহার করা হয় খাঁটি খাসির চামড়া এবং মাঝখানে কিরণ অংশে ব্যবহার হয় সাতক্ষীরার বিখ্যাত লোহার পাউডার।
তবলা নির্মাণে রমেশ দাশ শুধু নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং তিনি যুক্ত থেকেছেন দেশের স্বনামধন্য সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। আর্য্য সংগীত সমিতি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ বেতার, বাগীশ্বরী সংগীতালয়সহ বহু প্রতিষ্ঠানের সাথে নিয়মিত তবলা সরবরাহ এবং সহযোগিতার মাধ্যমে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে গেছেন। সম্মাননা পেয়েছেন ‘রেওয়াজ শিক্ষা কেন্দ্র’ ও ‘চট্টগ্রাম যন্ত্র শিল্পী সংস্থা’-র মতো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।
এছাড়াও তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে সান্নিধ্য পাওয়া ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পণ্ডিত বিজন কুমার চৌধুরী, কিরণময় চৌধুরী, মনোরঞ্জন বড়ুয়া, উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া, উস্তাদ মিহির লালা,পণ্ডিত নির্মলেন্দু চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী,সাখাওয়াত হোসেন, সুদীপ সেনগুপ্ত, শান্তিময় চৌধুরী, মনোজ সরকার, রমণী মোহন দাশ, আশীষ চৌধুরী সহ প্রখ্যাত শিল্পীদের – যাঁদের উপস্থিতি নিউ তাল তরঙ্গকে করেছে আরও সমৃদ্ধ ও মর্যাদাপূর্ণ।
তবলা নির্মাণ একটি সূক্ষ্ম ও ধৈর্যসাধ্য প্রক্রিয়া। সাধারণত একটি তবলা তৈরি করতে সময় লাগে এক সপ্তাহের মতো। এই সময়ের মধ্যে কাঠ, ধাতু ও চামড়ার মান যাচাই করে ধাপে ধাপে নির্মাণ করা হয়। ডাঁয়ার জন্য ব্যবহার হয় ভালো মানের নিম কাঠ, যা স্থায়িত্ব এবং সুরের মান বজায় রাখে। বাঁয়ার জন্য ব্যবহৃত পিতল ও সিলভার উচ্চমানের ধাতু হিসেবে স্বীকৃত। তবলার মুখ বা “সাইহি” তৈরিতে লোহার গুঁড়ো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা তাল এবং শব্দের গভীরতা বাড়ায়।
রমেশ দাশ বলেন, “ভালো তবলা তৈরি করতে হলে কাঁচামাল বাছাইয়ের দিকে অত্যন্ত মনোযোগী হতে হয়। নিম কাঠের খোল, খাঁটি চামড়া ও ভালো মানের পাউডার না হলে তবলার ধ্বনি নিখুঁত হয় না।”
রমেশ দাশের পরিবার তাঁর জীবনের আরেকটি বড় শক্তি। স্ত্রী রেখা দাশ ও তিন সন্তান রুমা, সীমা এবং জয়ন্ত। ছেলে জয়ন্ত দাশ বর্তমানে লেখাপড়ার পাশাপাশি তবলা শিক্ষায় মনোনিবেশ করেছে এবং পিতার সঙ্গে তবলা নির্মাণেও সহযোগিতা করছে। এ যেন প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়া এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত জীবনে আমি অনেক সুখী। আমার ছেলেও তবলার প্রতি আগ্রহী, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।” তাঁর হাত ধরে যারা নিউ তাল তরঙ্গ থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের সাফল্যও রমেশ দাশের জীবনের অহংকার।
যদিও তবলার প্রতি আগ্রহ এক সময় ব্যাপক ছিল, বর্তমানে এর চাহিদা কিছুটা কমে এসেছে বলে জানান রমেশ দাশ। তবে তিনি আশাবাদী, সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আবারও তবলা তার প্রাপ্য সম্মান ফিরে পাবে। তিনি বিশ্বাস করেন, সংগীত কখনো হারিয়ে যায় না – কেবল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তর ঘটে।
রমেশ চন্দ্র দাশ শুধুমাত্র একজন তবলা প্রস্তুতকারক নন, তিনি এক সাংস্কৃতিক যোদ্ধা, এক শিল্পানুরাগী যিনি নিজের শ্রম, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা দিয়ে সংগীতের এই অনন্য যন্ত্রকে রূপ দিয়ে চলেছেন। তাঁর সৃষ্টি শুধু একটি বাদ্যযন্ত্রে সীমাবদ্ধ নয়; প্রতিটি তবলা যেন একেকটি ছন্দময় ইতিহাসের প্রতীক।
তাঁর হাত ধরে সংগীত জগতে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য গুণীজন, তৈরি হয়েছে নতুন প্রজন্মের পথ। “নিউ তাল তরঙ্গ” শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি চেতনার নাম – যেখানে তাল, লয়, সুর ও সাধনার মেলবন্ধনে তৈরি হয় চিরন্তন বাংলা সংগীতের অনুষঙ্গ – তবলা।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
Leave a Reply