আজও উতলা হয়।
কলমে:- ড.প্রবীর কুমার পাল।
অঘ্রানের কড়া মিঠা রোদে সোনালী ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে পেরিয়ে যেতে যেতে দেখলাম,
এক মনে ধান কাটছে দিনমজুর সাঁওতালি মেয়েটা।
থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম—- আমাকে একটু ধান কাটার সুযোগ দেবে? বলল, হঁ রে বাবু, কাটবি তো কাট।
চেয়ে নিলাম কাস্তেটা।
শুরু করলাম ধান কাটা।
অনেকেই ভাববে এ আবার কি!
হাল ফ্যাশানে প্যান্ট শার্ট পরে শহুরে বাবুরা আবার ধান কাটে নাকি!
উত্তরটা আমার জানাই ছিল।
এখন তো সবাই প্যান্ট-শার্ট পরেই সারাবছর মাঠে চাষের কাজ করে।
আমিই বা বাদ যায় কেন?
তখন ছিলাম গ্রামে,তাই —–
গ্রামে থাকার সূত্রে চাষীবাসী ঘরের ছেলে হয়ে চাষের সব কাজই করতে হোত।
পৌষ মাসে ভোরের আজান দেওয়ার আগে গ্রাম থেকে মাইল দেড়েক দূরে ছাগল মাইরি কিংবা মুনিসায়েরের মাঠে প্রবল ঠান্ডায় হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে পৌঁছে যেতাম জমির মাথায় চার বাপ-বেটা।
এক আঁটি খড় জ্বালিয়ে প্রথমে হাত পা সেঁকে কাজে নেমে পড়া, পরনে লুঙ্গি আর জামা। চাদরটা পড়ে থাকতো আলের মাথায় চুপটি করে।
সূর্যের আলো না ফুটতে না ফুটতে এক পাই ধান কেটে ফেলতাম।
কিছুক্ষণ পর থেকে গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতো,
শীত তো পালাতে পথ পেতো না।
আস্তে আস্তে বেলা গড়াত আর তাকিয়ে থাকতাম দূরে গ্রামের পানে—–
কখন দিদি মাথায় করে বাটির উপর বাটি সাজিয়ে জলখাবার নিয়ে আসবে।
গাঁ থেকে বেরিয়েছে কিনা?
আলের ধারে বসে পেঁয়াজ থ্যাঁকলা কিংবা মুলো থ্যাঁকলা আর গুড় দিয়ে জল ঢেলে হপ হপ করে এক জামবাটি মুড়ি খাওয়া।
সে তো অমৃতের স্বাদ!
দুপুরে ঠিক পাশের পুকুরে মাঠের অন্যান্য চাষীদের সঙ্গে তেল মেখে এক ডুব দিয়ে পুকুরের পাড়ে মিঠেল রোদে চুনো মাছের টক দিয়ে আবারও এক জামবাটি ভাত। আস্তে আস্তে বেলা পড়ে আসতো।
পড়ন্ত বেলায় সূর্য ঢলে পড়তো নতুন গ্রামের আরও দূর পশ্চিমে,
ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত, বাড়ি পৌঁছে হাত-পা ধুয়ে তেল মাখা মুড়ি আর গরম চা যেন পরমান্নের স্বাদ এনে দিত। চোখে মুখে ফুটে উঠতো পরিশ্রান্তের ছাপ, কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম তা নিদ্রাদেবীই বলতে পারেন।
রাতে মায়ের ডাকে উঠে গরম ভাত খেয়ে আবার শুয়ে পড়া,
পরের দিনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি।
আজ সাঁওতাল রমনীর ধান কাটার দৃশ্য ফিরিয়ে দিল পুরনো দিনের কথা,
স্মৃতির পটে উঠে আসছিলো অনেক ছবি। বদলে গেছে দিন।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মাঠে এসে গেছে দৈত্যের মতো যন্ত্র দানব ধান মাড়াই কল। মাঠে নেই সেই দিনের মতো জড়ো করা ধানের আঁটি,
বোঝাই করা ধান নিয়ে ফেরা গরুর গাড়ির সারাদিন মাঠ আর ঘর,
আনাগোনা ক্লান্ত গরুর কিম্বা মোষের পিঠের উপর পাঁচনের বাড়ি,
আর আ-তেলা গাড়ির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ।
চোখের নিমেষে কয়েকদিনে সোনালী ধানের মাঠ শুধুই ফাঁকা, নিস্তব্ধতা।
সারা মাঠে বোকার মত পড়ে থাকে প্রাণহীন খড়ের গাদা।
ওগো সোনালী ধান তোমার কাঁচা খড়ের গন্ধে মনটা আজও উতলা হয়।
Leave a Reply