1. sajalnath8181@gmail.com : admin2020 :
শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন

ম্যক সি।

জাহাঙ্গীর আলম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০২২
  • ২১০ বার পঠিত

ম্যক সি
কলমেঃ- জাহাঙ্গীর আলম

বান্দরবান যখন ঘন অরণ্যে দূর্গম জনমানব শূন্য,তখন যাতায়াতের এক মাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা।বাজালীয়া, দোহাজারী,হতে নৌকায় উজানে আসতো চাঁটগাইয়া লোকেরা,তারা বনজ দ্রব্য সংগ্রহ করে ফিরে যেতো।
বন্য হিংস্র প্রাণীর ভয়ে তখন বসতি স্থাপনের চিন্তা করেনি কেউ। সমতলে স্ব-স্ব স্থানে লোক সংখ্যা কম থাকায় পাহাড়ে বসবাসের প্রয়োজনও ছিলনা।

বার্মা হতে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ,মারমা সম্প্রদায় পর্যায়ক্রমে রামু,চকরিয়া,কেরানী হাট,বাজালীয়া হয়ে কালক্রমে চট্টগ্রামের সমতল এলাকা হতে বাঙালী মাঝির নৌকায় চড়ে পাহাড়ে প্রবেশ করে।উপরোল্লেখিত স্থান সমুহে তাদের কিছু কিছু বৌদ্ধ স্থাপনার পুরাকীর্তির ধংসাবশেষ এখনো আছে,কিছু নিশ্চিহ্ন হয়েছে।ঐ সমস্ত এলাকার কিছু জায়গার নাম করনে মারমা অবস্থানের সাক্ষ্য বহন করে।ভাষা এবং সংস্কৃতির মিল না থাকায় ঐসকল স্থান ত্যাগ করে কালক্রমে তারা তাদের মত নিরুপদ্রপ জীবন যাপন করার জন্য পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে।
অতঃপর মারমাদের সাথে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী,চাকমা তংচংগ্যা,বম,খেয়াং,খুমি,লুসাই,
ত্রিপুরা,পাংখোয়া,ম্রো( চিম্বুকের আদী সন্তান)এবং বাঙালী জাতি গোষ্ঠীর মানুষের সমাগম হয় বান্দরবানে।

চাটগাঁইয়া মাঝির নৌকাতে চড়ে মার্মারা প্রথমে বান্দরবানে আসে।

বানরকে চাটগাঁইয়া ভাষায় বান্দর বলা হয়।এই বিষয় নিয়ে স্থানীয় মারমা ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর লোককথা প্রচলিত আছে।বান্দরবান শহরের পাশ দিয়ে একটি ঝিরি বয়ে গিয়েছে। সেই ঝিরি পারাপার হতো বানরের বড় ঝাঁক।এতে মনে হতো বানর দিয়ে বাঁধ রচিত হয়েছে।মার্মা ভাষায় বানরকে”ম্য”বলা হয়।তাই এই ঝিরির নাম ম্যকচি ঝিরি।

বান্দরবানকে মারমা ভাষায় বলা হয় “রোয়া দ আরাং” বা রোয়া দ। রোয়া শব্দের অর্থ গ্রাম বা বসবাসের এলাকা,”আরাং” শব্দের অর্থ-আসল বা মূল। মার্মা ভাষায় “ম্যকসি” মানে বানর দ্বারা রচিত বাঁধ।
চাটগাঁইয়া ভাষায় বানরকে বান্দর বলা হয়।ম্যক সি শব্দের চাটগাঁইয়া অর্থ “বান্দর দ্বারা বান ” সংক্ষেপে বান্দরবান।
কিন্তু “রোয়াদ ” বা “রোয়াদ আরাং” নামটি সরকারী খাতায় অথবা সাধারণের মুখে মুখে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর মানুষেরা এই অঞ্চলে বাঙালীদের বহু আগে থেকে বসবাস শুরু করেছিল।বৃটিশ আমলে বোমাং সার্কেল গঠিত হয়। মারমা সম্প্রদায় সার্কেল এর নেতৃত্বের সুযোগ পেয়েছিল।রাজ পরিবারের প্রায় সকলেই উচ্চ শিক্ষিত ছিল। সকল সরকারের সাথে তাদের যোগাযোগও ভালছিল।

সে যাই হোক চাটগাঁইয়াদের দেওয়া “বান্দরবান” নামটি সরকারী খাতায় রেকর্ড ভুক্ত হয়েছে।
বান্দরবান আবাদের ক্ষেত্রে চাটগাঁইয়াদের ভুমিকা অপরিসীম।এলাকার নাম করণের মধ্যেই চাটগাঁইয়াদের ভুমিকা সূর্যালোকের মত উজ্জ্বল।

চাটগাঁইয়া নৌকার মাঝি এবং বনজ দ্রব্য সংগ্রহকারীদের পা প্রথমে বান্দরবানে পড়েছে।

বান্দরবানের পাহাড়ের নৃ গোষ্ঠীর লোকেরা নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের প্রয়োজনে চট্টগ্রামের সমতল এলাকার উপর নির্ভরশীল।নৌকা যোগে পন্য উজানে আসতো এবং বেচাকেনা করে ,সওদাগরেরা ধান,চাউল,ভুট্টা,কাউন,বিনি,তিল,
তুলা ইত্যাদি নিয়ে যেতো।ব্যবসার প্রসার দেখে কিছু লোক বান্দরবানে এবং সাঙ্গু নদীর উজানে দোকানপাট স্থাপন করে।উভয়ের মধ্যে মধুর সম্পর্ক স্থাপন হয়।যোগাযোগের জন্য বাঙালীরা কিছু কিছু পাহাড়ী ভাষাও রপ্ত করেছিল।তাতে একে অপরকে বুঝিতে আরো সহজ হয়েছিল।সুখ,দুঃখ ভাগাভাগি হতো,সেই শেকড়ের সম্পর্ক এখনো আশা জাগায়।
পরে কিছু অর্থশালী লোক দাদন ব্যবসা খুললো।তাদের বেশী ভাগ ছিল হিন্দু মহাজন।ধূর্ত মহাজনের কাছে দেনার দায়ে তখন অনেক সরল দরিদ্র পাহাড়ী ফতুর হয়েছে।তথাপি শান্তি পূর্ণ সহাবস্থান ছিল।

বান্দরবান বাজারের দোকান ঘর গুলো প্রায় সবগুলি কাঠ বাঁশ দ্বারা নির্মিত ছিল,তার মধ্যে শুধু মাত্র হাজী সুলতান আহম্মদ ও হাজী ফয়েজ আহাম্মদ এর কাপড়ের দোকান ও যোগেন্দ্র মহাজনের দোকান পাকা ছিল।

১৯৭৬ সালে লাগাতার ১৫/২০ দিনের বিরামহীন বৃষ্টিতে বান্দরবানের ইতিহাসের মহাপ্লাবন হলো।এই মহাবন্যায় রেকর্ড পরিমান পানি হলো। বান্দরবান বাজারের উপর সব চেয়ে উঁচু জায়গা,বর্তমান মাস্টার মার্কেটের কাছে অশ্বত্থ গাছের তলায়ও পানি উঠিল।বাজারে পাকা রাস্তায় গলা পরিমান পানি হল।
কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ,রাজগুরু ক্যাং,রাজবাড়ি,এসডিওর বাংলো,উপজেলা ভবনের সামনের -সার্কেল অফিস,বর্তমান সোনালী ব্যাংকের বিপরীতে -সিএন্ডবি
অফিস,হিলবার্ড লাগোয়া কৃষি গুদাম,তিন নং অফিসে-সিএন্ডবি গুদাম।ব্যতিত কোন পাকা ঘর ছিলনা। বান্দরবান থানার ঘরটিও কাঠের মাচাং ঘর ছিল।
থৈ থৈ পানিতে মানুষ ডনবস্কো উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং কিছু উঁচু খামার বাড়িতে,যে যার মত আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বাঁচলো।শুক্রবারে পানি উঠায় মুসলমানেরা কেয়ামতের পূর্ব লক্ষণ মনে করে ভীত হল।সাঙ্গু নদী দিয়ে মরা হাতি ভেসে গেল। মানুষ,জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একমায়ের সন্তানের মতএকে অপরের খাবার ভাগাভাগি করল।সেই মধুর সম্পর্ক আর কোন দিন ফিরে আসবেনা।

১৯৭৭ সাল।শীত কালে গভীর রাতে খবর আসলো বান্দরবান বাজারে আগুন লেগেছে।আমিও আগুন নিভাতে গেলাম, সাধারণ জনগনের সাথে মিলিটারিরাও সাহায্য করল।পটিয়া হতে আগুন নিভানোর জন্য আসা দমকল বাহিনীর গাড়িটি বাসস্টেশনের উপরের মোড়ে সোজা গিয়া ঝিড়িতে পড়ে এককর্মী নিহত হল।সেই গাড়ি হতে দমকল এনে কেবল ছাই নিভানো গেল।
ভোরের আলো ফুটিতেই দেখি, উত্তরে যোগেন্দ্র মহাজনের দোকান হতে দক্ষিনে চৌকিদারের দোকান পর্যন্ত। পূর্বে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পেছন হতে মন্দিরের পাশ ধরে বাজারের জুমা মসজিদ সহ নদীর পাড় পর্যন্ত সব কিছু পুড়ে ছাই হল।তবুও মানুষ সংগ্রাম করে আবার দাঁড়াল।
ক্রমে বান্দরবানকে মহকুমা হতে জেলা ঘোষনা করা হল।সে সময়ে যেই সোনার সন্তানেরা চাকুরীর সুবাদে বান্দরবানে এসেছিল তাদের অধিকাংশ চালাক লোক, চাকুরির সুবিধা ব্যবহার করে জমি বন্দবস্তি /দখল করে অনাবাদি বান্দরবান আবাদ করে বন উজাড় করলো।নর বাড়ল,কাক বাড়লো।বানর পশু পাখি বিলুপ্ত হল।
সুরম্য দালান কোটা,বস্তি হলো।বৃষ্টির পানি আর নদীতে পড়ার সুযোগও রইলনা।
আশার কথা হলো,অল্প বৃষ্টিতে
কৃত্রিম বন্যা হলে ত্রাণ ইত্যাদি পাওয়া যায়।
জন বাড়লো ধন বাড়লো বটে তবে প্রকৃতির বড়ধন,বনাঞ্চল,নির্জনতা বিলুপ্ত হলো।
এখন ভ্রমন পিপাষু লোকের দল বান্দরবানে বেড়াতে এসে ন্যাড়া পাহাড়ের মেঘের ফাঁকে দাঁড়িয়ে সেল্ফি তুলে পরম তৃপ্তিতে ক্যাপশন দেয়-” আহা কি অপরূপ দৃশ্য”

আমি বলি – “ফিরিয়ে দাও অরণ্য লও এ নগর”

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..


© কথা৭১.টিভি দ্বারা সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত।
themesbazarkotha71254